
পঞ্চাশোর্ধ্ব সখিনা খাতুন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডং বরিয়ংয়ের বাসিন্দা। ১৯ দিন পাহাড়ি পথ বেয়ে বান্দরবানের আলীকদমে আসেন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে। এর পর সেখান থেকে পৌঁছান কক্সবাজার উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
রাখাইনে চলমান সংঘাতে সখিনার মতো অনেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। দালালদের মাধ্যমে তারা নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। ফেব্রুয়ারিতে অনুপ্রবেশ করেছেন এমন অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গার নাম-পরিচয় পেয়েছে সমকাল। এসব রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন করে ৬০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্যাম্পে আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা বলছেন, প্রায় প্রতিদিন নতুন করে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। কোনো কোনো দিন ৩০-৩৫ পরিবার একসঙ্গে ঢুকছে।
উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা নুর মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চলছে। ফলে এখনও মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিছুদিন আগে লম্বাশিয়া ক্যাম্পে কিছু নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তারা থাকার জন্য ঘর-জায়গা খুঁজছে।
সম্প্রতি অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা সখিনা খাতুন সমকালকে বলেন, আরাকান আর্মি তাদের রাখাইন রাজ্যে থাকতে দেয়নি। গ্রামবাসীকে আরাকান আর্মি তাড়িয়ে দিচ্ছে। গত মাসে তাঁর পরিবারসহ রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামের ২০ জন একসঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। ১৯ দিন পাহাড় পেরিয়ে শিশুদের নিয়ে হেঁটে আসতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক সময় গাছের লতাপাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেছেন। দালালকে মিয়ানমার মুদ্রায় ১৫ লাখ কিয়েট (প্রায় ৪৫ হাজার টাকা) দিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছেন তিনি।
আরাকান আর্মির গুলিতে মিয়ানমারে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে জানিয়ে বলেন, তাঁর কয়েক স্বজন মারা গেছেন। তাই প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তারা।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের যে সীমান্ত আছে, এর ব্যাপ্তি বান্দরবান থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত। সীমান্ত যে ভূপ্রকৃতি আছে, তার অধিকাংশ দুর্গম এলাকা। এই দুর্গম অঞ্চলে অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সব সময় তৎপর এবং সতর্ক অবস্থানে আছে। এটি মাদক ও চোরাকারবারপ্রবণ এলাকা। সীমান্তের ওই পাশে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গৃহযুদ্ধ চলমান। এই রকম একটি জটিল সমীকরণের মধ্যে বিজিবিকে কাজ করতে হচ্ছে। দুর্গম এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তৎপরতা সব সময় থাকে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করতে সীমান্ত এলাকায় দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। দালালরা ২০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিনিময়ে সীমান্ত দিয়ে রাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। অন্তত ২০ জনের বেশি দালালের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন– টেকনাফের বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সালমান, শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউসুফ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন ও মো. সাদ্দাম। পুলিশের তালিকায় মানব পাচারে জড়িত হিসেবে তাদের নাম রয়েছে। মামলাও আছে তাদের নামে। দালালরা সীমান্তে অন্তত ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাখাইন রাজ্য থেকে নৌকায় নাফ নদ পেরিয়ে এ দেশে অনুপ্রবেশ করে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে ৫৫ বছরের হোসেন আহমেদের বাড়ি মিয়ানমারের বুথিডং হইয়াছড়ি গ্রামে। দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ থেকে প্রাণে বাঁচতে পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন তিনি। কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের স্বজনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।
হোসেন আহমেদ বলেন, নাফ নদের ওপারের পতেংজা গ্রাম থেকে নারী-শিশুসহ ১০০ জন নৌকায় ওঠেন। পরদিন ভোরে এপারের শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছান।
মিয়ানমারের দালালদের মাধ্যমে আসেন তারা। এ জন্য ৮ লাখ কিয়েট (মিয়ানমারের মুদ্রা) দালালকে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাখাইনে প্রায়ই ড্রোন হামলা হয়। এতে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। হামলায় তাঁর ২০ জনের বেশি স্বজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন বলে জানান।
কক্সবাজারের জাদিমোড়া ক্যাম্পে সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছেন মোছাম্মৎ বিবি জাহান। তিনি জানান, এক বছর আগে আরাকান আর্মি তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে মংডুর এক স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পে রেখেছিল। একদিন তারা ক্যাম্প থেকে সব তরুণকে নিয়ে চলে যায়। তাদের কোনো হদিস পাননি স্বজন।
মংডুর সুদাপাড়ার বাসিন্দা মো. ইউনুস (৪০) আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার একটি ক্যাম্পে। তিনি বলেন, জানুয়ারিতে প্রথম দিকে আরাকান আর্মি তাদের গ্রামে আসে। সবাইকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে। আর কখনও যেন ফিরে না আসার হুঁশিয়ারি দেয়। কিছুদিন পর তারা আবার এসে কোনো কথা ছাড়াই বাড়িঘরে একদিক থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্যদিক থেকে বেপরোয়া গুলি চালাতে থাকে। তখন পরিবার নিয়ে ঘর ছাড়েন তিনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি পরিবারের ২৯ জন নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। তারা হলেন– রুহুল আমিন, হামিদা, মোহাম্মদ ফারুক, খুসমিদা, মোহাম্মদ হারিস, আসমা বিবি, জিসমা বিবি, মোহাম্মদ রিয়াজ, ইব্রাহিম, তসলিমা, আসরাফুল ইসলাম, আব্দুল হাসেম, রুসমিদা, মোহাম্মদ হাসির, মোহাম্মদ রিয়ান, সালমান, সিদ্দিক আহমেদ, আসমা, সারজিদা, শাহ আলম, শফি আলম, রুপি আলম, রমিদা, সোহানা, সাহানা, রশিদ উল্লাহ, লায়লা বেগম, মোহাম্মদ শহিদ ও হাবিবা। উখিয়ার লম্বাশিয়ার ওয়েস্ট ক্যাম্পের রোহিঙ্গা ফারুক আহমেদ, আবদুল মতলব, গোলজার খাতুন, মোহাম্মদ তবরক ও তফুরা বেগমের আশ্রয়ের রয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে নতুনভাবে রোহিঙ্গারা আসছে। তাদের গণনা করা হচ্ছে। সুত্র; সমকাল
পাঠকের মতামত